এছাড়া নুন পরিমানমতো | কুমারজিৎ দত্ত



বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল, সামনের দেবদারু গাছটা বিচ্ছিরিভাবে দুলছিল, ৪ টে ছাতারে পাখি অবিরাম ডেকে চলেছে। রিমা ওদের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এসে এক এক বার সামনের গেটের দিকে দেখে যাচ্ছিলো জীবক আসছে কিনা, আবার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিলো। আজ ওদের দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী, জীবক কথা দিয়েছিল তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু ৬.৪৫ বাজছে তবুও ফেরার নাম নেই। ওরা বিয়ের পর কলকাতাতেই ছিল ১ বছর রিমা বেশ খুশিই ছিল, সল্টলেকে ওর বাপের বাড়ী থেকে ওদের ফ্ল্যাটের দূরত্ব ছিল দুটো রাস্তা, জীবকও ৬ টা বাজলেই অফিস থেকে ফিরত। তারপর জীবক চাকরি নিয়ে চলে এলো গ্রেটার নয়ডাতে, প্রথমে খুব আপত্তি করেছিল সবাই, রিমাও কিন্তু জীবকের কেরিয়ারের প্রশ্নে হার মেনেছিলো সবাই।

অদ্ভুত জায়গা এই গ্রেটার নয়ডা, মনে হয় পুরো অংকের বই, সেক্টরগুলোর নাম আলফা, বীটা, গামা, ডেল্টা, ইটা, জিটা, নিউ, মিউ, চাই, পাই, ওমিক্রন ইত্যাদি চওড়া রাস্তা কিন্তু সেই রাস্তা দিয়ে যাবার গাড়ির সংখ্যা সারাদিনে হাতে গোনা যাবে। জীবক বলছিলো গোটা গ্রেটার নয়ডার ৭৫% বাড়িই নাকি খালি। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ, পার্ক আর পার্ক। প্রথম প্রথম ভালোই লাগতো রিমার কিন্তু কলকাতার হুল্লোড়ে বাঙালির কাহাতক আর এই প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ভালো লাগে, তারউপর এখানে আসার পর থেকে সকাল ৯টায় বেরিয়ে যায় জীবক আর বাড়ী ফেরে রাত ৮টায়। সারাদিন একাকিতত্ব কুঁড়ে কুঁড়ে খায় রিমা কে।
কলিং বেলের শব্দে আই হোলে চোখ লাগিয়ে গেট খুললো রিমা। "আর বোলো না যা বৃষ্টি, আস্তে আস্তে গাড়ী চালাতে হচ্ছিল তাই একটু দেরী হলো। প্লিজ বি রেডি মহারানী আমি বার বি কিউ নেশনে টেবিল বুক করেছি।" এক নিঃশ্বাসে বলে থামলো জীবক।
- আমার মন নেই, ক্যানসেল ইট" শান্ত স্বরে বললো রিমা।
- হোয়াট ইস দিস সোনা, ত্রিপাঠী আর ওর মিসেসকেও বলেছি, তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও।
- আমাকে জিজ্ঞাসা করে বুক করোনি, আমার কোনো দায় নেই যাবার।" রিমার গলা থেকে একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়লো।
- দেখো রিমা, সারাদিন খেটেখুটে আসার পর আমার এই সব নাটক ভালো লাগে না। যা বলছি করো।
- আমি কোথাও যাবো না। তোমার সঙ্গে সিরিয়াস কথা আছে আমার। আমি আর পারছি না।
- তোমার ওসব ফালতু কথা শোনার মতো টাইম আমার নেই। আমি ব্যাগ রেখে আসছি, তুমি রেডি হও।
সারা সন্ধে বিশেষ কথা বলেনি রিমা। বিবিকিউ তে বিশেষ কিছু খায়নি ও। ত্রিপাঠীর বউ রিকোয়েস্ট করলেও "তাবিয়াত নাসাজ হ্যায়" বলে পাশ কাটিয়েছে। জীবক লক্ষ্য করলেও সিন ক্রিয়েট করেনি।
"তোমার কি হয়েছে রিমা!!!! আজ একটা শুভ দিনেও এরকম করছো কেনো তুমি??" মৌন ভাঙলো জীবক।
"আমার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয় এই ভাবে। হয় তুমি চাকরি পাল্টে অন্য কোথাও চলো না হলে আমাকে বাড়ী পাঠানোর ব্যবস্থা করো।" রিমা অশান্ত কণ্ঠে বললো।
এসির ফ্যান স্পীডটা এক দাগ বাড়িয়ে জীবক একদম শীতল কণ্ঠে বল্লো "আমার সঙ্গে থাকতে গেলে এখানেই থাকতে হবে, ১০০ বার বলেছি কোনো স্কুল জয়েন করো না হলে আরো কিছু করো, ভালো ব্যাডমিন্টন খেলতে বললাম ওটা কন্টিনিউ করো। কিছুই করবে না তো আমি কি করবো? আমার পক্ষে চাকরী ছাড়া সম্ভব নয়, বাবা মার চিকিৎসা, ফ্ল্যাটের ইএমআই সব আমার চাকরিতে।"
"বেশ আমি কাল চলে যাবো। আই হ্যাভ ডিসাইডেড।"
"কটায় ফ্লাইট বোলে দিয়ো আমি চলে আসবো।"
"দরকার নেই, আমি চলে যাবো। তুমি কাল এক্সট্রা চাবি নিয়ে যেয়ো।"
'বেশ' বোলে পাশ ফিরে শুলো জীবক।

কলকাতায় এসে ক্রেয়ন বলে একটা প্লে স্কুল জয়েন করেছে রিমা। সময় বেশ কেটে যায়। আজ ৭৫ দিন হয়ে গেল ও কলকাতা এসেছে। জীবক ওর বাবাকে ফোন করে নিয়মিত খবর নিলেও ওকে ফোন করেনি। রিমাও ফোন করার প্রয়োজন বোধ করেনি। রাত্রে শোবার সময় একা ঘরটা বড্ডো মনে পড়ায় জীবককে। মনে হয় চিৎকার করে কাঁদে, কেনো জীবক সেদিন ওকে আটকালো না, কেনো নয়ডা যাবার পড়েই ওরকম নেগলেক্ট করতে শুরু করলো ওকে, এসব সাত পাঁচ ভেবে চোখ ভিজে যায় রিমার। এক এক বার ভাবে ফোন করবো কিন্তু ভিতরের একটা ভয়ঙ্কর ইগো সেটা করতে দেয় না।
"হেই ইউ মিস মালহোত্রা ইউ ডোন্ট নো হাউ টু মেক এ সিম্পল পিপিটি? গো, গো আউট ফ্রম মাই কেবিন।" জীবকের এই রকম স্বভাব বিরোধী চিৎকার শুনে গোটা অফিস ওর কেবিনের দিকে তাকালো। জীবক বুঝতে পারলো ও ভুল করছে কিন্তু গত আড়াই মাস ও নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে। ছোটো ছোটো ব্যাপারে রেগে যাচ্ছে। রিমা যাবার পর থেকেই এরকম হচ্ছিলো। অফিসে দুহাত দিয়ে মাথা চেপে বসে পড়লো ও। রাত্রে বিছানায় শুয়ে আজ জীবক ভাবছিলো কোথায়, ঠিক কোথায় ভুল হোলো? সব তো ঠিকই ছিলো তাহলে কেনো, রিমার রাগের কারণ এখনো ঠিক বোঝেনি জীবক, নাকি বুঝতে চাইছে না। মাথাটা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাবে মনে হচ্ছে, ফ্রিজের উপরে রাখা 100 পাইপারের বোতল টা খুলে পেগ বানালো জীবক।
আজ ওদের স্কুলের পিকনিক, বাচ্চাদের গার্জেনরা, ওরা সবাই মিলিয়ে। রিমাই ঠিক করেছে ভেন্যু চিংড়িঘাটা, ওর মামার এক বন্ধুর ভেড়ি আছে সেই সূত্রে জায়গা ইসিলি পাওয়া গেছে একটা বাগানবাড়িতে। ওদের স্কুলের সব ম্যাডামরা হাজবেন্ডদের নিয়ে এসেছে, রিমা এক। স্কুলের বাচ্চাদের বেশির ভাগের মা এসেছেন শুধু অর্চন বলে একটি ছেলের মা ছুটি পায়নি বলে ওর বাবা এসেছেন। ভদ্রলোক খুব জলি, রিমার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে। উনি বেশ মজার মজার অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিলেন রিমাকে, ওনার কুয়েতে থাকার গল্প, ওনার এখানকার বিসনেস ইত্যাদি। রিমার বেশ ভালো লাগলেও জীবককে খুব মিস করছিলো ও।
সকালে ক্যাকটাস পার্কে মর্নিং ওয়াক করতে গিয়ে সান্যাল দম্পতির সঙ্গে দেখা জীবকের, স্যানালরা বীটা ২ তে থাকে। "তা বসু কি খবর? মোহন বাগান জিতবে?" মিস্টার সান্যাল মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন।
- "হ্যাঁ হ্যাঁ জিতবো। শুধু এডু টা ঠিক ঠাক গেম দিলেই হলো।"
- তা বটে, ভালো ডিফেন্ডার না হলে জেতা খুব কঠিন।
-হুম
- ও হো একটা কথা, আগে তো মিসেস কে নিয়ে আসতে কদিন দেখছি না কি ব্যাপার?
- এখানে নেই ও, কলকাতা গেছে।
- কি মশাই, কি ব্যাপার!!!! ঝগড়াঝাঁটি নাকি?
- না না এমনি
- বুঝলে ভায়া ভালো ডিফেন্ডার ছাড়া যেরকম ম্যাচ জেতা যায় না ঠিক সেরকম গিন্নি না থাকলে বিয়ের পর বিছানায় এপাশ ওপাশ ছাড়া গতি নেই। তাই বলছি ধরে বেঁধে ক্ষমা টমা চেয়ে নিয়ে আসুন। এখানে ইগো চলে না।

রমা পিসি এসেছিলো আজ। জীবকের নিজের পিসি, উনি আবার সম্পর্কে রিমার মামীমা। রিমা কে খুব ভালোবাসেন, প্রচন্ড ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা। দুপুরে খাবার পর ওর সঙ্গে কথা হচ্ছিল রিমার।
"বুঝলি রিমু সব শুনলাম তোর মায়ের কাছে, তা রাগটা কিসের সেটাই বুঝলাম না।"
"কিছু নয় পিসি, যার আমার জন্য সময় নেই, আমারও তার জন্যে নেই।"
" তা বেশ আজকের রান্নাটা কেমন হয়েছিল বলতো।"
"দারুন, শুধু মৌরলা মাছ ভাজায় নুনটা একটু বেশি হয়ে গেছিলো।"
"নুন বুঝলি, নুন। ওই নুনটাই আসল, কি সংসার আর কি মৌরলা চচ্চড়ি, অন্য কিছু কম বেশি চলে যাবে কিন্তু নুন কম বা বেশী চলবে না।"
"হুম" বলে কি যেনো ভাবতে শুরু করলো রিমা।
ওয়াটস এপ এসএমএস টা সেন্ড করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো জীবক, ও কম্পিউটারে মেল চেক করতে লাগলো ফুরফুরে মনে। কোনো এক কুণ্ঠায় ফোন করতে বাঁধছিল ওর, তাই মেসেজ এই লিখলো রিমাকে। মেল বক্স খুলে প্রথমেই দেখলো রিমার মেল।
জীবু,
আমাদের ভালোবাসায় নুনটা একটু কম হয়ে গেছিলো কোনো ভাবে, কাল থেকে আমি চেষ্টা করবো পরিমানমতো নুন দিতে তুমিও কি সেই চেষ্টা করবে, জবাব যদি হ্যাঁ হয় তাহলে কালই টিকিট পাঠাও। আর যদি না হয় তাহলেও টিকিট পাঠাও আমি নিজেই চেষ্টা করবো, এক একাই।
ইতি
সোনাই।
টুং করে ওয়াটস এপ এ মেসেজ নিজের উপস্থিতি জানান দিলো। রিমা ওয়াটস এপ খুলে দেখে জীবকের মেসেজ। পড়তে শুরু করলো,
সোনাই,
এই ৮০ দিনে বেশ ভালোই বুঝেছি যে শুধু সনি বা কাটসুমি দিয়ে আই লীগ জেতা যায় না। একটা বেলো রাজ্জাক ও খুব দরকার। তুমি না হয় সনি বা কাটসুমি হোও আমি না হয় বেলো ই হবো। কাল দুপুরের ফ্লাইটে আসছি তোমাকে নিতে। তোমার ট্রেডমার্ক মৌরলা চচ্চড়ি রেডি রেখো, ওই দিয়ে ভাত খাবো।
ইতি
জীবু।
পাশের ঘরে ৯২.৫ বিগ এফএম এ বাজচ্ছিলো
"এ ব্যাথা কি যে ব্যাথা বোঝে কি আনজনে?
সজনী আমি বুঝি, মরেছি মনে মনে।"
ফেসবুক ক্রমাগত আমাদের গ্রুপ শেয়ারিং ব্লক করে চলেছে, সুতরাং, মোহন বাগান সম্পর্কিত সমস্ত খবর সবার আগে পেতে এক্ষুনি ব্লগ এর উপরে পুশ বটন অ্যালাও করে দিন আর আমাদের ফেসবুক পেজেলাইকের মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখুন, পোস্টটি পছন্দ হলে শেয়ার করতে অবশ্যই ভুলবেন না কিন্তু, লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজে "আমরা মোহনবাগানি" ব্লগের পাশে থাকবেন। - জয় মোহন বাগান

loading...

No comments

Powered by Blogger.