এ এক অন্য প্রেমের গান | রুপায়ন দে



“দাদু, দাদু । আজ উদ্বাস্তু গুলোকে পুরো পুরে দিয়েছি । বড্ড পাঙ্গা নিয়েছিল । মেরে ফাটিয়ে দিয়েছি শালা গুলোকে” । এক টানা কথা গুলো বলতে বলতে ছুটে আসছিল অনি । গায়ে মোহনবাগানের পতাকাটা তখনও জড়ানো । আজ খেলা ছিল মোহনবাগান ইষ্টবেঙ্গলের । মোহনবাগান জিতেছে আজ । মোহনবাগানের একনিষ্ঠ সমর্থক অনির তাই আজ আনন্দের দিন । কিন্তু কাকে মেরেছে সে ? দাদু হীরালাল বাবু জিজ্ঞাসা করতেই আবার বলা শুরু করল অনি । 

“জানো দাদু, খেলা শেষে ফিরছিলাম । কয়েকজন বাঙাল বাচ্চা আমায় সোনাগাছির মাল বলছিল । শালাদের মেরে ফাটিয়ে দিয়েছি ” । কথাটা শেষ হল না । হীরালাল বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন । আর নিজের ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন । অনির অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই । সেও নিজের ঘরে চলে গেল । হীরালাল বাবু নিজের ঘরে ঢুকেই টলমল পায়ে দেওয়ালের কাছে এলেন । যেখানে প্রাণের বন্ধু বাবলুর মালা পড়ানো ছবিটা ঝোলান আছে । চোখটা জলে ভরে উঠল হীরালাল বাবুর । অবাক দৃষ্টিতে বাবলুর ছবির দিকে তাকিয়ে হারিয়ে গেলেন নিজের ফেলে আসা যৌবনের উপবনে । হীরালাল দত্ত । হীরু । পশ্চিমবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম । 

সালটা ঠিক মনে নেই । তবে ওই ১৯৩৫-৩৬ সালের মধ্যেই হবে । সারা ভারত বর্ষের বুকে তখন ছড়িয়ে পড়েছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন । যুবক যুবতী থেকে বৃদ্ধ বৃদ্ধা রাস্তায় নেমেছে এক সংকল্প বুকে নিয়ে । চাই স্বাধীনতা । পরাধীনতা হীনতায় আর কেউ বাঁচতে চায় না । হীরুর বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী । ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন । বাবার মুখে শুনতে শুনতেই দেশপ্রেমের মহত্ত্ব বোঝার শুরু । একটা দেশের স্বাধীনতার জন্য তখন লড়ছে লাহোরের ভগৎ সিং, চট্টগ্রামের মাষ্টার দা, মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনী । শুনেছিলেন মোহনবাগানের ১১ যোদ্ধার খালি পায়ে খেলে গোরাদের হারানোর ইতিহাস । রবীন্দ্রনাথ কবি নজরুলের জ্বালাময়ী লেখা । আর নেতাজীর সেই যুদ্ধ । হীরু বড় হচ্ছিল এমন এক পরিস্থিতি মধ্যে যেখানে লড়াই করে বাঁচাটাই স্বাভাবিক । 

এমনই এক সন্ধ্যায় হীরু পড়তে বসেছে সবে । দৌড়ে এল হীরুর বাবা । কিছু একটা বলল তার মাকে । কিছু বোঝার আগেই হীরুকে কোলে তুলে পিছনের রাস্তা দিয়ে দে ছুট । হীরুকে কোলে নিয়ে দৌড়চ্ছে তার বাবা । আর একটা পুঁটলি নিয়ে তার মা । জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দৌড়াতে গিয়ে হীরু দেখল, তাদের বাড়িটা আগুনে পুরে ছাই হয়ে গেল । কিন্তু থামার উপায় নেই । ছোট্ট হীরু সব কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝল যে মা কাঁদছে । আর বাবা সান্ত্বনা দিচ্ছে । এই ভাবেই সারারাত চলতে চলতে বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়ল ছোট্ট হীরু । ঘুম ভাঙার পড়ে সে দেখল এক নতুন জায়গায় এসেছে । একটা ভাঙাচোরা ঘর । হীরুদের নতুন বাড়ি । নতুন জীবন শুরু । এখানেই বড় হতে লাগল হীরু । দেশ স্বাধীন হল । চারিদিকে শুধু আনন্দ আর খুশি । ইংরেজরা দেশ ছাড়ছে । কিন্তু সেদিন হয়ত ভারতবাসী বুঝতেও পারেনি, কি বীভৎস হানাহানির বীজ বপন করে দিয়ে যাচ্ছে ইংরেজ রা । 

সালটা হবে ১৯৫০-৫২ । হীরু তখন ১৫-১৬ বছরের যুবক । পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও করে । এমনই একদিন খেলার মাঠ থেকে ফিরে হীরু দেখল, তাদের বাড়িতে কারা যেন এসেছে । একজন ভদ্রলোক, একজন ভদ্রমহিলা আর একজন তারই বয়সী ছেলে । খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারল, ছেলেটির নাম বাবলু । দেশ ভাগের ডামাডোল পরিস্থিতির মধ্যে প্রাণটুকু নিয়ে পালিয়ে এসেছে বাবলুরা । বাবলুর বাবাও স্বাধীনতা সংগ্রামী । হীরুর বাবার পূর্বপরিচিত । তাই সব খুইয়ে যখন কলকাতায় এল, যাওয়ার ঠিকানা বলতে কিছুই নেই । অগত্যা হীরুর বাবার কাছেই এসে উঠেছে । হীরুর বাবাও দুহাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নেন বাবলুর বাবাকে । বাবলু কে স্কুলে ভর্তি করেন । বাবলুর বাবাকে কাজে ঢুকিয়ে দেন । বেশ ভালোই চলছিল সব কিছু । কিন্তু হঠাৎ সবকিছু এলে মেলো হয়ে গেল হীরুর জীবনে । দুদিনের জ্বরে মারা গেল হীরুর বাবা । মাথার উপর থেকে ছাদ চলে যাওয়ার মত অবস্থা । কি হবে এই ভেবে যখন হীরুর মায়ের মাথায় হাত, তখন হাল ধরল বাবলুর বাবা । 

হীরু তখন ১৮-১৯ বছরের যুবক । ফুটবলার হবার নেশা । কিন্তু সংসার তো চালাতে হবে । তাহলে কি ভেঙে যাবে স্বপ্ন ? নাহ । ভাঙতে দিল না বাবলু । নিজে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কাজে ঢুকল । কিন্তু বন্ধুকে ফুটবল ছাড়তে দিলনা । বছর ঘুরতেই হীরুর গায়ে উঠল সবুজ মেরুণ জার্সি । সাথে চাকরি । সকালে প্র্যাক্টিস, তারপরে অফিস । হীরু যখন ভালো চাকরি করছে, তখন বাবলুর রোজগার সামান্য । কিন্তু মুখ ফুটে বন্ধুকে বলতে পারেনি কখনও । নিজের পা টা শক্ত হতেই তাই একদিন হীরু, বাবলুকে সটান নিয়ে গিয়ে হাজির করল অফিসে । সবকিছু বলাই ছিল । হীরুর অফিসে চাকরি হয়ে গেল বাবলু । আনন্দে চোখে জল দুই বন্ধুর । একে অপরের গলা জড়াজড়ি করে বাড়ি ফিরল । তারপর থেকেই হীরু আর বাবলু এক সাথে অফিস যেত । হীরুর প্র্যাক্টিস থাকলেও বাবলু ওর সাথে বেরোত । এরই মধ্যে হীরুর একটু নাম ডাক হয়েছে । ১-২ গোলও করেছে । 

এবার সামনে ডার্বি । মরনপণ লড়াই । ইতিমধ্যেই মোহনবাগান ইষ্টবেঙ্গলের দ্বৈরথ এক উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে । অফিসের ঘোষবাবু তো বলেই রেখেছে । ইষ্টবেঙ্গল জিতবে । আর মাংস খাওয়াতে হবে । হীরু ও চ্যালেঞ্জ নিয়েছে । কিন্তু খেলার ফল যাই হোক । লাভ কিন্তু বাবলুর । একে ইষ্টবেঙ্গলের সমর্থক । আর প্রাণের বন্ধু খেলে মোহনবাগানে । যেই জিতবে । তাতে বাবলুর ই জেতা । খেলার দিন অবশেষে হাজির । বাবলু আজ বসেছে ইষ্টবেঙ্গলের দিকে । খেলা শুরু হল । এক দুই তিন করে আশি মিনিট হয়ে গেল । কেউ গোল করতে পারল না । অবশেষে ৮২ মিনিটে ইষ্টবেঙ্গলের গোল করে এগিয়ে যাওয়া । ওই এক গোলেই সেবার ম্যাচ জিতল । উত্তাল ইষ্টবেঙ্গল গ্যালারি । কিন্তু একি । বাবলুর তো কোন আনন্দ হচ্ছে না । সবাই চলে গেছে । তাও সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল হীরুর জন্য । সবার শেষে বিধ্বস্ত শরীরটাকে টানতে টানতে হীরু বেড়িয়ে এল । জীবনের প্রথম ডার্বি সে হেরে গেছে । বাবলু তাকে ভরসা দিল । এটাই শুরু । বাবলুর ভরসা মনে বল জোগাল হীরুর । প্রতিজ্ঞা করল ডার্বি জেতার । অফিসের ঘোষ বাবুর টিপ্পনীর মোকাবিলা হোক কিংবা আরও লড়াইয়ের প্রেরণা । হীরু আর বাবলু একে অপরের পরিপূরক । 

এই তো সেদিন অফিসের দাস বাবুকে ধরে পিটিয়ে দিয়েছে হীরু । দাস বাবুর অপরাধ উনি বাবলুকে বলেছিলেন বাঙাল । বাঙাল কেন বলবে ? তার বন্ধু বাঙালি । ভারতীয় । সবার উপর মানুষ । সব কিছু হারিয়ে ছিন্নমূল হয়ে আসা মানুষটাকে কিসের ভিত্তিতে দাস বাবু অপমান করলেন ? শুধুমাত্র এদেশীয় হওয়ার জন্য ? মেনে নিতে পারেনি সে । বাবলুও তেমনি । ঘোষবাবুর টিপ্পনীর হাত থেকে হীরুকে বাঁচিয়ে চলে সে । ইতিমধ্যে ফিরতি ডার্বি হাজির । বাবলু প্রতিজ্ঞা করাল হীরুকে দিয়ে, জিতে তবে মাঠ যেন সে ছাড়ে । অনবদ্য খেলেছিল সেদিন হীরু । হীরুর করা জোড়া গোলে মোহনবাগান সেদিন জেতে । ইষ্টবেঙ্গলের হার হলেও বন্ধুর জয়ে আজ বাবলু জয়ী । এরপর থেকে কেটে গেছে অনেক বছর । অনেক ডার্বি । অনেক লড়াই । কিন্তু অমলিন থেকে গেছে হীরু বাবলুর বন্ধুত্ব । কখনও মরচে পরেনি তাতে । এমনকি বছর খানেক আগে বাবলুর মৃত্যু হওয়ার পরেও । 

৭৫ এর হীরু এখন মৃত্যু পথযাত্রী । অপেক্ষা শুধু বাবলুর কাছে যাওয়ার । এতক্ষণ এসবই ভেবে যাচ্ছিল হীরু । সম্বিৎ ফিরল একটা শব্দে । বৌমা ভাত নিয়ে হাজির । সাথে চিংড়ির মালাইকারি । অনি জেতার আনন্দে কিনে এনেছে । কিন্তু নাহ । আজ আর খেতে ইচ্ছা করল না । বাবলুর কথা গুলো কানে বাজতে থাকল । যেন ছবি থেকে বেরিয়ে এসেছে বাবলু । বলছে “ ভাই, মনে আছে ? আমায় বাঙাল বলেছিল বলে তুই দাস বাবুকে মেরেছিলি ” ? তৎক্ষণাৎ হীরুর স্বাগতক্তি, সে তো তুই ও আমায় ফুটবলের মানে শিখিয়েছিল । শিখিয়েছিলি, “বিপক্ষের কনুই, শর্ট, মার, ট্যাকেল কখনও জাত, ধর্ম দেখে আসেনা । সে শুধু জিততে চায় ” । “ নোংরামি সেদিনও ছিল । আজও আছে । কিন্তু বদলে গেছে ভাষা জ্ঞান । বদলে গেছে রুচিবোধ । তাই আজকের ছেলেরা অবলীলায় কারোর মা, কারোও বোন তুলে গালি দিতে পারে । সামান্য জেতা হারাকে কেন্দ্র করে মারামারি করতে পারে । 

তাই যতদিন যাচ্ছে, ততই হীরু আর বাবলুরা হারিয়ে যাচ্ছে, ছেয়ে যাচ্ছে দাস আর ঘোষবাবুতে । যারা ফুটবলটাই বোঝে না । অথচ আজও আমরা ঘটি বাঙাল একসাথে স্কুল কলেজ যাই । একসাথে অফিস করি । সব কিছু ঠিকঠাক চলে । তাহলে কেন আজকের ছেলেরা এই নোংরামি তে জড়িয়ে পড়বে ” ? কথাগুলো বলতে বলতে গলাটা বুজে এল হীরালাল বাবু । চোখ ভরে উঠল জলে । চশমার কাঁচটা খুলে চোখ টা মুছে আবার চশমা পড়তেই অবাক হয়ে গেল । বাবলু কোথায় গেল ? এখানেই তো ছিল । তাহলে কি মনের ভুল ? দেওয়ালে টাঙানো বাবলুর ছবিটার দিকে তাকাল । যেন বাবলু ডাকছে । আর বলছে, চলে আয় ভাই । আর থাকিসনা এই নোংরামির মধ্যে । চলে আয় । তুই এলে আবার আমরা ফিরে যাব আমাদের যৌবনের দিনগুলো তে । সেই খেলার সবুজ মাঠ । প্র্যাক্টিস । একসাথে পথ চলা । লালহলুদ আর সবুজমেরুণ জার্সি পড়ে গলা জড়িয়ে হেঁটে যাওয়া । ফিরে যাওয়া সেই দিন গুলোতে । যেখানে আছে বন্ধুর প্রতি নিষ্ঠা । ভালোবাসা । যেখানে ফুটবল মানে হানাহানি না । সম্প্রীতির মেলবন্ধন ।
ফেসবুক ক্রমাগত আমাদের গ্রুপ শেয়ারিং ব্লক করে চলেছে, সুতরাং, মোহন বাগান সম্পর্কিত সমস্ত খবর সবার আগে পেতে এক্ষুনি ব্লগ এর উপরে পুশ বটন অ্যালাও করে দিন আর আমাদের ফেসবুক পেজেলাইকের মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখুন, পোস্টটি পছন্দ হলে শেয়ার করতে অবশ্যই ভুলবেন না কিন্তু, লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজে "আমরা মোহনবাগানি" ব্লগের পাশে থাকবেন। - জয় মোহন বাগান

loading...

No comments

Powered by Blogger.